ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাবন্দী লেখম মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর বাংলাদেশে এ আইন নিয়ে বিতর্ক এবং সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। অনেকেরই অভিযোগ এ আইন অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়রানির এবং অপব্যহারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আইন কার্যকরের মাত্র দুই বছরের মধ্যেই দাবি উঠেছে আইনটি একেবারে বাতিল করে দেয়ার।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন ধারায় হয়রানির সুযোগ আছে উল্লেখ করে সাংবাদিক, সুশীল সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকেও শুরু থেকেই আইনটি নিয়ে আপত্তি ছিল। দেখা যাচ্ছে, আইনটি কার্যকর হওয়ার পর মাত্র দুই বছরেই শত শত মামলায় বহু মানুষকে জেল খাটতে হয়েছে।
কারাগারে মারা যাওয়া মুশতাক আহমেদের সঙ্গে একই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় পাঁচ মাস কারাবন্দী ছিলেন মোঃ দিদারুল ইসলাম। তিনি রাষ্ট্রচিন্তা নামের একটি সংগঠনের সদস্য।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা তো আমাদের জীবন দিয়ে জানি। প্রত্যেকটা শব্দ উচ্চারণ করার আগে আমরা দশবার চিন্তা করি। এই শব্দটাতে আমি কি ধরা খাব কিনা! আমার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব তারাতো আমার নিরাপত্তা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন।
দিদারুল ইসলাম জামিনে মুক্ত হলেও এখনো নানাভাবে প্রশাসনের নজরদারির মধ্যে আছেন বলেই জানান।
তার কথায়, সরকারের সমালোচকদের কণ্ঠরোধ আর ভয় দেখানোর এক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।
কথা বলার অধিকার আসলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। এই অধিকারটাকে একেবারে পরিকল্পনা করে আপনার কাছ থেকে নিয়ে নেয়া হয়েছে এবং সবচেয়ে কঠিনভাবে। কত কঠিন সেটাতো আমরা মুশতাকের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে দেখলাম।
হয়রানি নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ
বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত দুই বছরে সাংবাদিক, রাজনীতিক, শিল্পী, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, গার্মেন্টসকর্মী থেকে শিক্ষক ছাত্র পর্যন্ত আসামী হয়ে জেল খেটেছেন।
এ আইন নিয়ে বিতর্ক এবং উদ্বেগের মূল কারণ হিসেবে বলা হয় বেশকিছু ধারার মাধ্যমে যথেচ্ছা হয়রানির সুযোগ রয়েছে।
এ আইনের ৪৩ ধারায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি, জব্দ এবং আটকের অসীম ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আর আইনে ব্যাক্তি বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তী ক্ষুণ্ন করা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা উস্কানি, মানহানিকর তথ্য প্রচার ও প্রকাশ এবং আইন শৃঙ্খলার অবনতির মতো বিষয়গুলোতে বিভিন্ন ধারায় অপরাধ ও শাস্তির বিধান রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ভুল ব্যাখ্যার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।
আইনের ৯টি ধারা নিয়ে আপত্তি ছিল সম্পাদক পরিষদের
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা বলেন, সংবিধানে নাগরিকদের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার দিয়েছে। যেখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অনেক ক্ষেত্রে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে।
সবার মধ্যে একটা ভীতি যে এইটা বললে কী হবে! এবং আমরাও বলি যে এতকিছু বলো না তোমার বিপদ হবে। এটা স্বাধীন দেশে আমরা কেন করবো? এটা কিন্তু বেশ স্বার্থকভাবে সরকার করে ফেলেছে। সেল্ফ সেন্সরশিপ একটা ভীতি প্রদর্শন, ভীতি মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া।
১৪টি ধারায় সংঘটিত অপরাধ অজামিনযোগ্য
এদিকে শুরু থেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারায় আপত্তি দিয়েছিল সম্মাদক পরিষদ। আইনের ১৪টি ধারায় সংঘটিত অপরাধকে অজামিনযোগ্য হিসেবে রাখা হয়েছে।
মুশতাক আহমেদ এবং অন্যান্য আসামীদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১/২৫(১)(খ)৩১/৩৫ ধারায় মামলা দেয়া হয়। এর মধ্যে ২১ ধারার অপরাধ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অজামিনযোগ্য।
মামলার এজাহারে বলা হয়, মুশতাক আহমেদ এবং আসামীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন গুজব, সরকার বিরোধী পোস্টের মাধ্যমে সমাজে বিভ্রান্তি, অস্থিরতা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপরাধ করেছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেছেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে
কারাগারে মুশতাক আহমেদের মৃত্যুতে প্রতিবাদ বিক্ষোভ এবং আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ২৭শে ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে আইনের প্রসঙ্গটি উঠেছিল।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা তার বক্তব্য স্পষ্ট করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে কিনা এটা হলো দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। এখন কোনটা আপনার কাছে অপপ্রয়োগ আর কোনটা অপপ্রয়োগ না এটা একটা আপেক্ষিক ব্যাপার।
আমি তো মনে করি আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে এবং চলবে। যদি কেউ অপরাধ না করে তার বিচার তার শাস্তি হবে না।
এদিকে দেখা যাচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা বা গ্রেপ্তার হলে অপরাধ প্রমাণের আগেই দীর্ঘদিন কারাভোগ করতে হচ্ছে। লেখক মুশতাক আহমেদ ছয়বার জামিনের আবেদন করেছিলেন, কিন্তু তাকে জামিন দেয়া হয়নি। মৃত্যুর আগে প্রায় ১০ মাস ধরে তিনি কারাগারে বন্দী ছিলেন।
সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এ আইনে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখছেন অনেকেই।
অধ্যাপক শাহনাজ হুদা বলেন, তথ্য প্রযুক্তির যুগে ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যুগোপযোগী আইন থাকার প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু বর্তমান আইনটি ঢেলে সাজানো দরকার।
২০১৮ সালে জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ হয়
এখন যেহেতু দুই বছর পার হবার পর আমরা দেখেছি যে কত ধরনের অনিয়ম অপব্যবহার বা অপপ্রয়োগ হয়েছে। সেটা অবশ্যই যারা এক্সপার্ট আছে তাদের মতামত নিয়ে এটাকে অবশ্যই অবশ্যই পুরোপুরিভাবে, ঢালাওভাবে এটা পরিবর্তন করতে হবে।
এদিকে মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি বাতিলের দাবি উঠেছে।
যদিও অব্যাহত প্রতিবাদের সংস্কার প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, এই আইনে কোনো অপরাধের অভিযোগ এলে পুলিশের তদন্তের আগে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না বা তার বিরুদ্ধে মামলা নেয়া যাবে না, এমন একটি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
কিন্তু এ ব্যবস্থা বিদ্যমান সংকটের কতটা সমাধান করতে পারবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়।