Home Economics ছুটিই নেই ২৯% প্রবাসী কর্মীর

ছুটিই নেই ২৯% প্রবাসী কর্মীর

২০১৭ সালে সৌদি আরবে পাড়ি দেন লক্ষ্মীপুর জেলার সোহাগ মোল্লা। রিক্রুটিং এজেন্সি থেকে বলা হয়েছিল জেদ্দায় একটি বিপণিবিতানে চাকরি হবে তার। তবে সেখানে পৌঁছার পর তাকে নিয়োগ দেয়া হয় একটি কৃষি খামারে। যাওয়ার আগে রিক্রুটিং এজেন্সি যে বেতন ও সুযোগ-সুবিধার কথা বলেছিল, তার কোনোটাই পাননি তিনি। কোনো রকম ছুটি ছাড়াই টানা আড়াই বছর ওই কৃষি খামারে কাজ করতে হয়েছে সোহাগকে। কাগজে-কলমে তাকে যে বেতনের কথা বলা হয়েছিল, তার সিংহভাগ কেটে রাখা হতো থাকা-খাওয়াসহ বিভিন্ন খাত দেখিয়ে। অভিবাসনের খরচ সম্পত্তি বন্ধক রেখে জোগাড় করলেও প্রথম বছর দেশে টাকা পাঠাতে পেরেছিলেন সামান্যই। তার ওপর গত বছর করোনার কারণে টানা কয়েক মাস বেতনও পাননি সোহাগ।

সোহাগ মোল্লা বণিক বার্তাকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী সৌদি আরবে সপ্তাহে দুই দিন (শুক্র ও শনিবার) ছুটি ভোগ করার কথা কর্মীদের। যদিও তার মতো আরো অনেক কর্মীই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন কোনো ছুটি ছাড়াই। শহরের বাইরের বিভিন্ন কৃষি খামারে এভাবেই কাজ করতে হয় তাদের। মালিকের অনুমতি ছাড়া কেউ যদি একদিনের জন্যও ছুটি নেন তার পরিণতি হয় ভয়াবহ। চাকরিও চলে যায় অনেকের। আর একবার চাকরি হারালে অবৈধ হিসেবে লুকিয়ে আরো কম বেতনে কাজ করতে বাধ্য হতে হয়। করোনার কারণে কর্মী কম থাকায় এ প্রবণতা আরো বেড়েছে।

একই অবস্থা ওমান প্রবাসী রাসেল আলমেরও। ওমানেও সরকারি ও বেসরকারি সব সেক্টরেই সাপ্তাহিক ছুটি দুদিন (শুক্র ও শনিবার)। তবে ২০১৬ সাল থেকে ওমানে থাকা রাসেল কখনো সাপ্তাহিক ছুটি ভোগ করতে পারেননি। তবে মালিকের ইচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতে তিন মাস পরপর এক-দুই দিনের ছুটি পেয়েছিলেন তিনি। সেটাও ছিল অবৈতনিক। রাসেল বলেন, এখানে আসার আগে এজেন্সি বলেছিল, সপ্তাহে একটি করে ছুটি পাব, আর সেজন্য বেতনও কাটার কথা ছিল না। কিন্তু সেটা শুধু কাগজেই।

শুধু এ দুজনই নয়। প্রবাসে মাসের পর মাস ছুটিবিহীন কর্মজীবন কাটাচ্ছেন ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ অভিবাসী বাংলাদেশী। অভিবাসী কর্মীদের নিয়ে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে এমন চিত্র উঠে এসেছে। ‘অভিবাসন ব্যয় জরিপ’ শিরোনামের ওই জরিপে বলা হয়েছে, সাপ্তাহিক কর্মদিবস শেষে কর্মচারীরা যেন বিশ্রাম পান এবং নিজের সুবিধামতো ছুটি কাটিয়ে কর্মশক্তি বাড়াতে পারেন, সে উদ্দেশ্যে পূর্ণ বেতন ও সুবিধাসহ কমপক্ষে একদিন ছুটি ভোগের অধিকার দেয়া উচিত। যদিও ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ কর্মীই সপ্তাহ শেষে কোনো ছুটি পান না। সপ্তাহে দুদিন ছুটি পান মাত্র ২ দশমিক ৩ শতাংশ অভিবাসী কর্মী। ছুটিবিহীন কাজের ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারী কর্মীদের অবস্থা আরো শোচনীয়। ৭৩ দশমিক ৩ শতাংশ নারী কর্মীই কোনো রকম ছুটি ছাড়া কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ছুটি না পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে দুরবস্থায় আছেন সৌদি আরব প্রবাসী বাংলাদেশীরা। দেশটিতে থাকা ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ কর্মীই কোনো ছুটি ভোগ করতে পারেন না। প্রায় একই রকম অবস্থায় রয়েছেন ওমান প্রবাসী কর্মীরাও। সেখানে থাকা বাংলাদেশী কর্মীদের মধ্যে ৩৫ দশমিক ১ শতাংশের সাপ্তাহিক ছুটি নেই। এছাড়া কাতারে ২০ দশমিক ৩ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ১২ দশমিক ৭ শতাংশ এবং সিঙ্গাপুরে থাকা ৭ দশমিক ১ শতাংশ বাংলাদেশী কর্মী কোনো ছুটি ভোগ করতে পারেন না।

এদিকে নানান কারণ দেখিয়ে জোর করে প্রবাসী কর্মীদের বেতনও কেটে রাখা হয়। অভিবাসী শ্রমিকদের মজুরি থেকে যে অর্থ কেটে নেয়া হচ্ছে তার মধ্যে আটটি কারণ উঠে এসেছে সমীক্ষায়। সেখানে দেখা গেছে, খাওয়ার খরচ বাবদ ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ, বাড়ি ভাড়া বাবদ ২২ দশমিক ২ শতাংশ এবং বিদেশী কর্মীর কর বাবদ ৫ দশমিক ৭ শতাংশ অর্থ কেটে নেয়া হচ্ছে। এর বাইরে সামাজিক নিরাপত্তা, আয়কর লেভিসহ অন্যান্য কারণ দেখিয়ে এসব অর্থ কেটে নেয়া হচ্ছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, ৪৭ দশমিক ৮ শতাংশ কর্মীই জানেন না যে তাদের মজুরি থেকে এসব অর্থ কী কারণে কেটে নেয়া হচ্ছে।

জরিপে দক্ষতাভেদে অভিবাসী কর্মীদের মজুরি থেকে কাটা অর্থেরও ব্যাপক পার্থক্য দেখা গেছে। বিশেষ করে গৃহকর্মীদের ক্ষেত্রে এ পার্থক্য সবচেয়ে ভয়াবহ। তবে দক্ষ-অদক্ষের মজুরি কর্তনের পার্থক্য খুবই কম। দক্ষ কর্মীদের ৪৭ শতাংশ এবং অদক্ষ কর্মীদের ৪৫ শতাংশের বেতন কাটা হয়েছে। যাদের মধ্যে নারী গৃহকর্মীদের ১৮ দশমিক ৫ শতাংশের মজুরি থেকে অর্থ কাটা হয়েছে।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, প্রবাসে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মীরা কোনো রকম ছুটি ভোগ করতে পারেন না। বিশেষ করে নারী গৃহকর্মী যারা আছেন তাদের অবস্থা শোচনীয়। নারী গৃহকর্মীরা ছুটি তো পানই না উল্টো তাদের নির্দিষ্ট কোনো কর্মঘণ্টা নেই। বলা যায়, ২৪ ঘণ্টাই তাদের ডিউটিতে থাকতে হয়। আবার ছুটি না থাকায় তাদের একটি বাসায়ই মাসের পর মাস বন্দি থাকতে হচ্ছে, যা একরকম দাসপ্রথা। অন্যদিকে পুরুষ কর্মীদের অনেকেরই নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই। কর্মক্ষেত্রে ৮ ঘণ্টা ডিউটি বলা হলেও তাদের কাজ করতে হয় ১২-১৪ ঘণ্টা। আবার মাস শেষে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে বেতন কাটা হয়। কেউ হয়তো বাড়িতে টাকা পাঠাতে কিছু সময়ে কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিল আবার কেউ পাসপোর্ট রিনিউয়ের কাজে দূতাবাসে গিয়েছিল, মাস শেষে দেখা যায় ওই দিনের বেতনও কেটে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রবাসী কর্মীদের এসব দুর্দশা কম-বেশি সবাই জানে। তবে প্রথমবারের মতো সরকারি সমীক্ষায় এসব উঠে এসেছে। সে ক্ষেত্রে আশা করা যায় প্রবাসী কর্মীদের অধিকার আদায়ে সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ জোরদার হবে।

উল্লেখ্য, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সময়ে যারা অভিবাসী হয়েছেন, তাদের পরিবারের মধ্যেই দৈবচয়নের ভিত্তিতে জরিপটি করে বিবিএস। এজন্য জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) থেকে অভিবাসীদের তথ্যভাণ্ডার সংগ্রহ করা হয়। এ ক্ষেত্রে দৈবচয়নের ভিত্তিতে উত্তরদাতা ছিল আট হাজার অভিবাসী পরিবার। গত বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ দুই মাস ব্যক্তিগত সাক্ষাত্কার পদ্ধতিতে মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করে জরিপটি করেছে বিবিএস।

জরিপ অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০১৮ এ সময়কালে দেশের মোট অভিবাসী কর্মীর সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ ৩ হাজার। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশ ছিলেন পুরুষ। ৪ লাখ বা ১৫ শতাংশ ছিলেন নারী। জরিপে একজন অভিবাসীর সব মিলিয়ে বিদেশ যেতে কত টাকা খরচ হয়, আর মাসে কত টাকা আয় হয় এসব বিষয় তুলে আনা হয়েছে। এছাড়া জরিপটির মাধ্যমে অভিবাসীদের আর্থসামাজিক ও জনমিতির অবস্থা, অভিবাসীদের বৃত্তান্ত, ঋণ বা ধারের উৎস, ঋণ পরিশোধ, শ্রম অভিবাসীদের শিক্ষার অবস্থা, প্রধান গন্তব্যের দেশ কোনটি—এসব বিষয়েও তথ্য আনা হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here