তর্কসাপেক্ষে বিশ্বের সেরা তিনি, তাঁর বেতন কম হওয়ার কথা নয়। তবু বার্সেলোনার আর্থিক অবস্থার করুণ দশা দেখে বেতন ৫০ শতাংশ কমিয়ে চুক্তি নবায়নে রাজি ছিলেন লিওনেল মেসি। সেটাও আবার কীভাবে! বার্সা সভাপতি হোয়ান লাপোর্তা দুদিন আগে নিশ্চিত করেছেন, নতুন পাঁচ বছরের চুক্তিতে মেসি বার্সার হয়ে খেলতেন দুই বছর, কিন্তু এই দুই বছরের বেতনই পাঁচ বছরে ভাগ করে দেওয়া হতো।
তবু বার্সার বেতনের বিলের বোঝাকে কারণ দেখিয়ে মেসির চুক্তি নবায়ন হলো না। এ অবস্থায়ও দুর্মুখেরা মেসিরই সমালোচনা করে বলছেন, এতই যদি বার্সার প্রতি ভালোবাসা হয়, তাহলে বিনা বেতনে কিংবা আরও কম বেতনে কেন বার্সায় খেললেন না মেসি? তাহলেই তো বেতনের বিলের বোঝা কমানো বার্সার জন্য আরও সহজ হতো।
কিন্তু চাইলেই কি তা করতে পারতেন মেসি? সেটির ব্যাখ্যা খুঁজে বের করেছে স্প্যানিশ ফুটবলবিষয়ক ওয়েবসাইট ফুটবল এসপানা। তাদের বিশ্লেষণ বলছে, মেসি চাইলেই বিনা বেতনে বা অস্বাভাবিক কম বেতনে খেলতে পারতেন না!
বার্সার সঙ্গে মেসির আগের চুক্তি শেষ হয়ে গেছে ৩০ জুন, ১ জুলাই থেকেই কাগজে–কলমে বার্সার সঙ্গে মেসির সম্পর্ক ছিল না। তবু মেসির চুক্তি নবায়ন নিয়ে শঙ্কা ছিল না, গত মাসে অর্ধেক বেতনে মেসির পাঁচ বছরের চুক্তি নবায়নের পাকা খবর দিয়েছিল ইউরোপের সংবাদমাধ্যম। লাপোর্তাও গতকাল নিশ্চিত করেছেন, চুক্তিতে দুই পক্ষের সমঝোতা হয়েই ছিল।
কিন্তু চুক্তি আনুষ্ঠানিক রূপ পায়নি লিগের বেতনের সীমা নির্দিষ্ট থাকায়। একদিকে বার্সার ঋণের বোঝা গত কয়েক বছরে জ্যামিতিক হারে বেড়েছে, অন্যদিকে বার্সার বেতনের বিলও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। লাপোর্তা জানালেন, গত মৌসুম শেষেও বার্সার বেতনের বিল ছিল ক্লাবের আয়ের ১১০ শতাংশ! অর্থাৎ প্রতি মৌসুমে শুধু বেতন দিতেই আয়ের পুরোটা খরচের পরও ঋণ নিতে হতো বার্সাকে! এর পাশাপাশি ক্লাবের পরিচালন ব্যয় তো আছেই!
খেলোয়াড়দের বেতন কমিয়ে, খেলোয়াড় বিক্রি করে সে বোঝা কমানোর চেষ্টা করেছে লাপোর্তার বোর্ড। কিন্তু মেসির নিবন্ধন করাতে তা-ও যথেষ্ট হয়নি। সে কারণেই মেসির সমালোচনাকারীরা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন, মেসি বিনা বেতনে বা নামমাত্র বেতনে খেললেই তো লাপোর্তার কাজটা সহজ হয়ে যেত, সে ক্ষেত্রে অন্যদের বেতন কমিয়ে আর কয়েকজন খেলোয়াড় বিক্রি করেই মেসিকে বেতনের বিলে নিবন্ধন করানো যেত।বিজ্ঞাপন
স্প্যানিশ আইন অনুসারে, যেকোনো নতুন চুক্তিতে খেলোয়াড়ের বেতন তাঁর আগের চুক্তির বেতনের ন্যূনতম ৫০ শতাংশ হতে হয়
কিন্তু ফুটবল এসপানার বিশ্লেষণ, সেটি বাস্তবে সম্ভব নয়। ইংলিশ দৈনিক ডেইলি মিররে লেখা সাংবাদিক ও ‘দ্য ফ্রাইং প্যান অব স্পেন’ নামের বইয়ের লেখক কলিন মিলারের টুইটকে উদ্ধৃত করে কারণটা জানিয়েছে ফুটবল এসপানা।
মিলারের টুইটে লেখা, ‘বার্সেলোনায় মেসির বিনা বেতনে খেলা আইনত অবৈধ হতো। স্প্যানিশ আইন অনুসারে, যেকোনো নতুন চুক্তিতে খেলোয়াড়ের বেতন তাঁর আগের চুক্তির বেতনের ন্যূনতম ৫০ শতাংশ হতে হয় (আর্থিকভাবে ক্লাবগুলো যাতে নয়-ছয় করতে না পারে সে জন্যই এই নিয়ম)।’ টুইটের সঙ্গে স্প্যানিশ ফুটবলের চুক্তিসংক্রান্ত নিয়মের ওয়েবসাইটের লিংকও দিয়ে রেখেছেন মিলার।
বার্সা সভাপতি লাপোর্তার কথাতেও একটা সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। দুদিন আগে সংবাদ সম্মেলনে লাপোর্তা নিশ্চিত করেছিলেন, এত কাটছাঁটের পরও মেসিকে ছাড়াই বার্সার বেতনের বিল তাদের আয়ের ৯৫ শতাংশ! যেখানে এই বিল আয়ের ৭০ শতাংশের নিচে রাখার নিয়ম বেঁধে দিয়েছে স্প্যানিশ লিগ।
বিবিসি স্পোর্টসের সাংবাদিক রাজ চোহান টুইট করেছেন, ‘মেসির বিনা বেতনে খেলার যুক্তি (তাঁর সেটা করার দরকারই নেই) নিয়ে কিছু বিষয় পরিষ্কার করা যাক। বার্সার আয়-বেতনের অনুপাত এই মুহূর্তে প্রায় ১১৫ শতাংশ। মেসির বেতন ছাড়াই সেটা ৯৫ শতাংশ হবে। লা লিগার বেতনের সীমা নির্দিষ্ট করা আছে ৭০ শতাংশে। তাই মেসি যদি বিনা বেতনেও খেলতে চাইত, বার্সা তাঁকে নিবন্ধন করাতে পারত না।’
Just to clear something up about Messi playing for free (he shouldnât have to). Barcaâs wage to revenue ratio is currently at around 115%. Even without Messiâs wages, itâs still 95%. La Ligaâs salary cap is set at 70%. So even if Messi played for free,Barca couldnât register him.— Raj Chohan (@rajsinghchohan) August 8, 2021
ইউরোপিয়ান ফুটবলের ওয়েবসাইট ইউরোস্পোর্ট বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছে এ নিয়ে। মেসির আগের চুক্তি ৩০ জুন শেষ হয়ে যাওয়ায় মেসিকে আর বার্সার খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচনা করা সম্ভব ছিল না। তার মানে হচ্ছে, তাঁকে নতুন খেলোয়াড় হিসেবেই নিবন্ধিত করতে হতো। আর বার্সার বেতনের বিল মেসিকে ছাড়াই ৯৫ শতাংশ হওয়ায়, বার্সার দেওয়ার অসাধ্য কোনো বেতনের অঙ্কে নিবন্ধন করানো সম্ভব ছিল না।
যে কারণে এই মৌসুমে দলে আনা আগুয়েরো, মেম্ফিস, এরিক গার্সিয়া আর এমারসন রয়ালকেও এখনো নিবন্ধন করাতে পারেনি বার্সা। ইউরোস্পোর্ট লিখেছে, বার্সার এখন আর দেখেশুনে হিসাবের বই নিয়ন্ত্রণে আনার সময় নেই, বার্সার এখন প্যানিক করার সময়! মেসি বার্সা ছাড়ার পরও এখনো অবস্থাটা এমন যে নতুন আয়ের উৎস না এলে গ্রিজমান, কুতিনিও, উমতিতি, পিয়ানিচ, ব্রাথওয়েইটদের কাউকে বিক্রি করার আগপর্যন্ত বার্সা নতুন চার খেলোয়াড়কে নিবন্ধন করানোর উপায় নেই।
ইউরোস্পোর্টেই স্প্যানিশ ফুটবল নিয়ে লেখা সাংবাদিক এলিয়াস বাইলিফ টুইটে ব্যাখ্যা করেছেন মেসির বিনা বেতনে কিংবা কম বেতনে খেলার বিষয় নিয়ে। তিনি লিখেছেন, ‘এমন একজন খেলোয়াড়ের বেতনের বাজারদর যেটা, তার চেয়ে অবিশ্বাস্য কম বেতনের চুক্তি লা লিগা মেনে নিত না। স্প্যানিশ প্রথম ও দ্বিতীয় বিভাগের প্রতিটি চুক্তিই লা লিগা বিশ্লেষণ করে। এটার উদ্দেশ্য হচ্ছে আর্থিক প্রতারণা কিংবা বাজারদরের চেয়ে অবিশ্বাস্য রকম বেশি বেতনের চুক্তি প্রতিহত করা।’
বার্সার ঝামেলাটা কী ছিল, সেটার ব্যাখ্যায় বাইলিফ লিখেছেন, ‘বার্সার ক্ষেত্রে ১. বার্সার এই মুহূর্তে দলে থাকা খেলোয়াড়েরা গত বছরে আসলে বেতন কমাননি, শুধু সেটা পরে নেওয়ার চুক্তিতে সই করেছেন। ২. এবার বার্সা চারজন নতুন খেলোয়াড়কে দলে এনেছে। এবার ভাবুন, বার্সা মেসির সঙ্গে কম বেতনের (ধরুন বছরে ১ কোটি ইউরো) চুক্তি করল এবং সেটি লিগের কাছে জমা দিল। একদিকে আপনি বেতন কমাতে পারেননি, বরং নতুন চারজন খেলোয়াড় যোগ করেছেন দলে, অন্যদিকে আরেক খেলোয়াড়কে তাঁর বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম বেতন দিতে চাইছেন।’
এ ক্ষেত্রে লা লিগা কেন মানত না, সেটির ব্যাখ্যাও দিয়েছেন বাইলিফ, ‘(মেসির অবিশ্বাস্য কম বেতনের চুক্তি) লা লিগা মেনে নিত না, কারণ এটির কোনো মানে হয় না। তাদের লক্ষ্য (যদিও এটা বিশ্বাস করা কঠিন, আমি জানি) এটাই যে ক্লাবগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য যেন ভালো থাকে। আর (লা লিগা চায়) সেটা সত্যিকারের চেষ্টা দিয়েই করতে হবে ক্লাবগুলোকে, চুক্তিতে অবিশ্বাস্য ব্যবস্থা নিয়ে নয়।’