২০২০ সালের মার্চে যখন প্রথমবার লকডাউনের ঘোষণা হলো তখন শুরুতেই মানুষ ছুটলো গ্রামে। ঢাকায় থাকার অনিশ্চয়তা, করোনা সংক্রমণ বিষয়ে তথ্য না জানা-সব মিলিয়ে ঢাকা ত্যাগকেই একমাত্র উপায় হিসেবে বিবেচনায় নেয় তারা। এরপর অন্তত পাঁচবার তারা যাওয়া আসার মধ্যেই থাকলো। প্রত্যেকবারই গণপরিবহন না থাকায় ব্যাপক হারে গাদাগাদি করে ট্রাকে-ফেরিতে ছুটলো মানুষ। এর মধ্যে বড় অংশই ভোগান্তির শিকার হয়েছে গার্মেন্ট বন্ধ আর খোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে দোলাচলের কারণে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুরু থেকে এই যাওয়া-আসা ঠেকাতে না পারার কারণে পুরো দেশ সংক্রমিত হয়েছে। তারা বলছেন, একবার দুইবার হলে বোঝা যায় অভিজ্ঞতা না থাকায় সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু একই ভুল বারবার হলে ধরে নিতে হবে যারা সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছেন তারা জানেনই না তারা কী চান।
সর্বশেষ গত শুক্রবার (৩০ জুলাই) গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণায় গ্রাম থেকে ফিরতে শুরু করেছেন বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা। কঠোর লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে ও পায়ে হেঁটে আসছেন তারা। আবার অনেকে পিকআপ ভ্যানে ও ট্রাকে চড়েও আসছেন। শনিবার (৩১ জুলাই) হাজার হাজার শ্রমিকের ভোগান্তির পরে সন্ধ্যায় ঘোষণা আসে রবিবার বেলা ১২টা পর্যন্ত গণপরিবহন থুলে দেওয়ার।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গার্মেন্ট মালিকরা কারখানার আশেপাশের শ্রমিকদের দিয়ে ‘আপাতত’ কাজ চালানোর শর্তে কারখানা খোলার কথা বলছে। কেবল এইবার না, ২০২০-এর এপ্রিলে একইভাবে টেনে আনা হয়েছিল শ্রমিকদের। সেবার বিজিএমইএ-বিকেএমইএ ঘোষণা দেয়, কাজ হবে নির্ধারিত কিছু বিভাগে। অবশিষ্ট কারখানাগুলো খোলা হবে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ধাপে। তবে, কারখানার মালিকরা চাপ না দিলেও চাকরি হারানোর আশঙ্কা কাটাতে কাজে যোগদানের উদ্দেশ্যে গ্রামে অবস্থানকারী প্রায় সব শ্রমিকই ঢাকামুখী হয়। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে এর আগে তীব্র সমালোচনার মুখে সরকারি ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করে দেশের সব পোশাক কারখানা ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করেছিল পোশাক মালিকদের বড় দুটি সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ।
গত তিন ঈদেও ছিল একই আলোচনা
এ বছর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় ঢাকার বাইরে যেতে নানাভাবে নিরুৎসাহিত করা হলেও ঈদের ছুটি শেষ হলেও গাদাগাদি করেই ঢাকায় ফিরেছে মানুষ। নৌ ও সড়ক পথে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করেই হাজারো মানুষকে রাজধানী ছেড়ে গেছে এবং ফিরে এসেছে। দূরপাল্লার পরিবহন বন্ধ থাকলেও নানা যানবাহনে ভেঙে ভেঙে ঢাকায় ফিরছে তারা। ফলে চাইলেও সামাজিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধি মানতে পারছে না অনেকে।
শ্রমিকদের কারখানায় আসার জন্য বিজিএমইএ’র সদস্যভুক্ত কোনও মালিক বাধ্য করছেন না বলে শনিবার জানিয়েছেন সংগঠনটির সভাপতি ফারুক হাসান। তিনি বলেন, ‘কারখানা চালু করতে সব শ্রমিকের প্রয়োজন হয় না। আপাতত, ঈদের ছুটিতে যারা বাড়িতে যায়নি এবং যারা স্থানীয় শ্রমিক তাদের দিয়ে কারখানা চালু করা হচ্ছে। তবে শ্রমিকরা হয়তো নিজ থেকে আসা শুরু করেছে।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘বারবার একই রকম ভুল করা থেকে বোঝা যায়, যারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারা কী চান জানেন না। যে কারণে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বারবার বদলাচ্ছেন। এখন যে বিধিনিষেধ চলছে সেটা শুরুর আগে বলা হয়, এবার আক্ষরিক অর্থে কড়াকড়ি লকডাউন হবে। কিন্তু সেটা শেষ না হতে গার্মেন্ট মালিকদের আবদার পূরণে কারখানা খুলে দেওয়া হলো। খোলা হলো বটে, কিন্তু কোনও যানবাহন না থাকায় আবারও বিপাকে পড়লো শ্রমিকরা। তারা যে যেভাবে পারলো আসতে শুরু করলো আগের মতোই। মানে হলো, যারা কাজটা করছেন তারা নিজেদের কাজটা জানেন না। সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং চূড়ান্তভাবে মুনাফার কাছে মানুষকে বলি দেওয়া হচ্ছে।’
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘ঢাকার বাইরে থাকা শ্রমিকরা ৫ তারিখ বিধিনিষেধ শেষ হওয়ার আগে কারখানায় না ফেরার শর্তে কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত হলেও কেন দলে দলে শ্রমিকদের ফিরতে হলো সে এক বিস্ময়। আমাদের অনেক সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। এত মানুষের জীবিকার বিষয়টি হেলা করা যাচ্ছে না, আবার কোভিড সংক্রমণের পরিস্থিতিও ভালো না। ফলে সবার জন্য যেটা ভালো সেই পথটিই খুঁজতে হবে।’