Home Bangladesh সাগরপথে ইউরোপ যাত্রায় শীর্ষে বাংলাদেশ

সাগরপথে ইউরোপ যাত্রায় শীর্ষে বাংলাদেশ

মহামারির মাঝেও উত্তাল ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে গত ২২ জুলাই প্রাণ গেলো ১৭ অভিবাসন প্রত্যাশী বাংলাদেশির। নৌকায় করে অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার পথে সাগরে ডুবে মারা যান তারা। তাদের মরদেহ উদ্ধার করে তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে বিভিন্ন দেশের আরও ৩৮০ অভিবাসন প্রত্যাশীকে।

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার এমন ঘটনা চলতি মাসেই বেশ কয়েকটি। আর যাত্রীদের মধ্যে বাংলাদেশিরাই বেশি। এর আগে গত ২৪ জুন ২৬৭ জনকে উদ্ধার করে তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড। যাদের ২৬৪ জনই ছিল বাংলাদেশি।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের তালিকায় শীর্ষে আছে বাংলাদেশ। ২১ জুলাই পর্যন্ত সমুদ্রপাড়ি দিয়েছে বিভিন্ন দেশের ৪১ হাজার ৭৭৭ জন। তাদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার আছে বাংলাদেশি। গত ১০ জুনও ১৬৪ বাংলাদেশিকে তিউনিসিয়া উপকূল থেকে উদ্ধার করা হয়।

এর আগে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার সময় ১৮ মে ৩৬ জন, ২৭ ও ২৮ মে ২৪৩ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করে তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড। এ বছর এভাবে মোট তিন হাজার ৩৩২ জন বাংলাদেশিকে উদ্ধার বা আটক করা হয়।

ইউএনএইচসিআর-এর তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত নানা দেশের ২২ লাখ ২৪ হাজার ২৪৫ জন মানুষ সাগরপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে আসে। একই সময়ে এ পথে আসতে গিয়ে মারা গেছে ২১ হাজার ৭০৭ জন।

এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুনের তথ্য অনুযায়ী, যত জন এভাবে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেছেন তার সাড়ে ১৪ শতাংশই ছিল বাংলাদেশি।

ইউরোপের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সমন্বয়ে দায়িত্বে থাকা ফ্রন্টেক্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে এভাবে ৬০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ করেছে।

দেশে ফিরতেই হলো
ময়মনসিংহের গফুরগাঁও উপজেলার ভরপুর গ্রামের মনজুরুল ইসলামকে কাজের কথা বলে প্রথমে আবুধাবি নেওয়া হয়। সেখান থেকে শারজাহ হয়ে  ওমানে যান তিনি। ওমানে একটি ঘরে তিনদিন থাকেন। আগে থেকেই সেখানে ৭-৮ জন বাংলাদেশি ছিলেন। সেখান থেকে সাগরপাড়ের আরেকটি ঘরে থাকতে হয় পাঁচদিন। সেখানে আরও ৩৫ জন বাংলাদেশির সঙ্গে দেখা হয় তার। সবার গন্তব্য গ্রিস।

একদিন রাতে তাদের ২০-২২ জনকে একটি নৌকায় উঠিয়ে ইরানের বন্দর আব্বাসে নেওয়া হয়। সেখানে মুক্তিপণ হিসাবে মনজুরুলের পরিবার থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা নেওয়া হয়। এরপর ইরান থেকে তুর্কি যান তারা। সেখান থেকে সাগর পাড়ি দিয়ে গ্রিসে। এরপর মেসেডোনিয়া, সার্বিয়া,  ক্রোয়োশিয়া, অস্ট্রিয়া হয়ে জার্মানি যান। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। জার্মানিতে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ফিরে আসতে হয় দেশে।

তরুণরাই বেশি আগ্রহী
মূলত মহামারির কারণে বিভিন্ন দেশের ফ্লাইট বন্ধ থাকার সুযোগ নিচ্ছে মানবপাচারকারী চক্র। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, ভিজিট ভিসায় দুবাই, এরপর ইরান হয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করা হয়।

আটক হওয়ার পর ফেরত আসা বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুবাই ও ওমানে নতুন আসা বাংলাদেশি তরুণরাই মূলত পাচারকারীদের প্রধান টার্গেট।

সমুদ্র পাড়ি দেওয়া এসব ঘটনা পর্যালোচনা করে জানা যায়, ২৬ থেকে ৪০ বছর বয়সীরা ইউরোপে ঢুকতে বেশি মরিয়া থাকে। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের তথ্যমতে, গত কয়েকবছরে ইউরোপ ও লিবিয়া থেকে ফেরত আসা ২ হাজার ২৮৪ জনের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, ঢাকা, নোয়াখালী, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা- এসব জেলা থেকে সবচেয়ে বেশি লোক এভাবে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। একেকজন খরচ করেছেন তিন থেকে ১৫ লাখ টাকা।

ইউরোপ যাওয়ার ১৮ রুট
বাংলাদেশ থেকে ১৮টি রুট ব্যবহার করে মানবপাচারের চেষ্টা চলে ইউরোপে। বাংলাদেশিরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছে ভূমধ্যসাগর। যা সেন্ট্রাল মেডিটেরানিয়ান রুট হিসেবে পরিচিত। সেখানে যাওয়ার জন্য যাত্রা শুরু হয় মূলত লিবিয়া থেকে।

এ বছরে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইতালিতে অনুপ্রবেশকারীদের ৬১ শতাংশই লিবিয়া থেকে এসেছে। সেখান থেকে ইতালি ও মাল্টায় অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল বাংলাদেশিরাই। গত কয়েকবছরে বলকান রুট দিয়েও প্রায় সাড়ে ছয় হাজার বাংলাদেশি প্রবেশ করেছে। এভাবে প্রবেশ করতে গিয়ে বসনিয়ার জঙ্গলে এখনও শতাধিক বাংলাদেশি আটক আছেন।

ফেরত আসা বাংলাদেশিরা জানিয়েছেন, মানবপাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত আছে বাংলাদেশি, পাকিস্তানি, আফগান ও ইরানের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানকারী দালালচক্র। তারা শুরুতে কাউকে টাকা ছাড়াই, কাউকে ৪০-৫০ হাজার আবার কাউকে ২-৩ লাখ টাকার বিনিময়ে গ্রিসে যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়। যারা কম টাকা দিতে চায় তাদের শর্ত দেওয়া হয় পৌঁছানোর পর বাকি ২-৩ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে।

এই দালালদের কাছে থাকে অত্যাধুনিক অস্ত্র। জঙ্গল, শহর ও গ্রামে তাদের বাসাও আছে। যেখানে তারা বিভিন্ন গ্রুপে অভিবাসী প্রত্যাশীদের আটকে রাখে। সেখানে থেকে ছাড়া পেতে আটক ব্যক্তির স্বজনদের কাছে চাওয়া হয় মুক্তিপণ। টাকা না দিলে হত্যা করে লাশ মরুভূমিতে পুঁতে ফেলা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়।

পাচারের প্রচার হয় টিকটক-ফেসবুকে
মানবপাচারের অন্যতম প্রচার মাধ্যম এখন টিকটক, লাইকি, হোয়াটস অ্যাপ। এমনকি ফেসবুক ব্যবহার করেও পাচারের ঘটনা ঘটছে। লিবিয়া থেকে সমুদ্রপথে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টাকে পাচারকারীদের ভাষায় বলা হয় ‘গেম’। এই ‘গেম’ এর খবর ফেসবুকে আসে বিভিন্ন গ্রুপে। ‘গেম’ হোক আর না হোক, ছবি পোস্ট করে প্রলুব্ধ করা হয়। লোভে পড়ে পা বাড়ায় আগ্রহীরা। বড় জাহাজের কথা বলা হলেও ওঠানো হয় নৌকা কিংবা রাবারের তৈরি উদ্ধারকারী বোটে। শুরু হয় অনিশ্চিত এক যাত্রা।

সম্প্রতি টিকটকের মাধ্যমে পরিচয়ের সূত্র ধরে কিশোরীদের ভারতে পাচারের ঘটনা উঠে এসেছে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নারী ও শিশু পাচার নিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথ একটি গবেষণা করেছে। তাতে দেখা গেছে, পাচারকারীরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সংকটে থাকা পরিবারের শিশু-কিশোরীদের পাচারের জন্য টার্গেট করে।

এ গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভারতে ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে নারী ভিকটিমদের পাচারচক্রের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এরপর তাদের বেশিরভাগকেই জোর করে যৌন পেশায় বাধ্য করা হয়।

ভারতে পাচার হওয়া প্রায় ২ হাজার নারীকে গত ১০ বছরে আইনি প্রক্রিয়ায় দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম পাচারের শিকার ৬৭৫ জন নারীর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে, ১৬ থেকে ২০ বছরের কিশোরীরা সবচেয়ে বেশি পাচারের শিকার। এরপরই আছে ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সীরা। তারা বেশিরভাগই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলার বাসিন্দা।

পুলিশ সদর দফতরের তথ্যমতে, ২০১২ থেকে ২০২০ পর্যন্ত মানবপাচারের যেসব মামলা হয়েছে তাতে দেখা গেছে, প্রায় ‍দুই হাজার নারী মানবপাচারের শিকার হয়েছেন। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০২০ সালে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমকালে উদ্ধারকৃত নারীর সংখ্যা ৩০৩ জন।

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ সাগরপথে ইউরোপে যাওয়ার দিক থেকে প্রথম। এটি আমাদের জন্য লজ্জার। বাংলাদেশের সঙ্গে এই তালিকায় আছে সিরিয়া, আফগানিস্তান, সুদান ও ইরিত্রিয়া। দেশগুলোতে যুদ্ধ ও দারিদ্র্যপীড়িত। বাংলাদেশের অবস্থা কিন্তু এমন নয়। তারপরও শুধু অলীক স্বপ্নে আমাদের লোকজন এভাবে ইউরোপে যাচ্ছে। শ্রম অভিবাসনের নামে ভিজিট ভিসায় দুবাই যাচ্ছে লোকজন। ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে নারী ও কিশোরিরা। পাচার প্রতিরোধে আমাদের যেমন সচেতন হতে হবে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।’

মামলায় অনীহা
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক ও আইসিটি) জি এস এম জাফরুল্লাহ বলেন, ‘মানবপাচার মামলার বিচার দ্রুত করা গেলে কাজ হবে। অপরাধীর বিচার নিশ্চিত হলে সাপ্লাই চেইনও বন্ধ হবে। আমরা ইমিগ্রেশনকে বলতে পারি যে ট্যুরিস্ট ভিসায় যারা যাচ্ছে তাদেরকে যেন আরও কঠোর মনিটরিংয়ে রাখা হয়।’

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মানবপাচার বিষয়ক সেলের বিশেষ পুলিশ সুপার সাইদুর রহমান বলেন, ভূমধ্যসাগর থেকে যারা ফেরত আসে তাদের কাছ থেকে কোনোভাবেই অভিযোগ নেওয়া যায় না। অনেকসময় তাদের এলাকায় আমাদের টিম পাঠিয়ে মোটিভেশন করে মামলা নিতে হয়। তারা যে মানবপাচারের শিকার হয়েছে সেটা জানাতে অস্বীকৃতি জানায় তারা।

তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন সময় যারা ফেরত এসেছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পারি, পাচারকারীরা ভিকটিমকে তথ্য গোপন রাখতে বলে। এগুলো নাকি প্রচার হলে তাদের ক্ষতি হবে, বিদেশ যাত্রা বন্ধ হয়ে যাবে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here